সমস্ত লেখাগুলি

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সাংবাদিকরা পরাধীন। -
প্রবীর ঘোষ
Nov. 19, 2024 | যুক্তিবাদ | views:879 | likes:0 | share: 0 | comments:0

এখনকার সংবাদপত্রগুলি অনেক প্রগতিশীল হয়েছে। সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে থাকে রাজনৈতিক হানাহানি। দ্বিতীয় পাতাতে থাকে কলগার্ল ও কলবয়দের ঢালাও বিজ্ঞাপন। কোনও সৎ সাংবাদিক এগুলো সরানোর কথা চিন্তা করে না। তারা জানে এসমস্ত বিজ্ঞাপন সরাতে গেলে মালিক লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে।


       এ’দেশের প্রতিটি বৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্র, জনপ্রিয় সাপ্তাহিক, টিভি মিডিয়ার পিছনে মূলধন হিসেবে খাটে কোটি কোটি টাকা। কোটিপতি মিডিয়া মালিকদের কাছে ‘মিডিয়া-ব্যবসা’ আর পাঁচটা ব্যবসার মতই ব্যবসা। উৎপাদন কর, খদ্দের ধর, বিক্রি কর। আর পাঁচটা ব্যবসার মতই এখানেও- যত বেশি উৎপাদন, যত বেশি বিক্রি, তত বেশি লাভ। অন্যান্য ব্যবসায় বড় ভাবে পুঁজি নিয়োগ করার আগে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিল্পপতিরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা চালান। প্রাথমিকভাবে বুঝে নেন মার্কেটের অবস্থা। তারপরে নামেন উৎপাদনে। বৃহৎ মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সম্ভাব্য পুঁজি বিনিয়োগকারী বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষা চালান। সমীক্ষকরা কয়েক মাসব্যাপী সমীক্ষা চালান নানাভাবে, যার একটা বড় অংশ জনমত যাচাই। তারপর তাঁরা রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে মিডিয়ার চরিত্র কী কী ধরনের হলে সম্ভাব্য পাঠক ও দ্রশক কতটা হতে পারে, তার একটা হদিশ দেওয়া হয়। এই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে পুঁজিপতি ঠিক করেন তার মিডিয়ার চরিত্রের রূপরেখা, ঠিক করেন পলিসি। কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন সম্পাদক থেকে সাংবাদিককারও। ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ ‘নিউজ চ্যানেলের স্বাধীনতা’ বলে শব্দ দুটি আমরা অহরহ শুনে থাকি। শব্দ দুটি নিয়ে ফি-বছর গোটা কয়েক সেমিনার হয় দেশের বড়-মেজ শহরগুলোতে। শব্দটি একটিই মাত্র অর্থ বহন করে আর তা হল মিডিয়া মালিকের মিডিয়া-চরিত্রকে বজায় রাখার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা নামের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে সব মিডিয়া মালিকদের সংগঠিত ভাবে আঘাত হানার স্বাধীনতা।


       সম্পাদক থেকে সাংবাদিকরা মালিকের কাছে ‘মিডিয়া পলিসি’ মেনে বলার ও লেখার অলিখিত চুক্তির বিনিময়েই চাকরিতে ঢোকেন। মিডিয়া পলিসিকে অমান্য করার মত ধৃষ্টতা কেউ দেখালে, পরের দিনই তার স্থান হবে মিডিয়া অফিসের পরিবর্তে রাস্তায়।


       সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের এই সীমাবদ্ধতার কথা স্পষ্টভাবে না জানা থাকার দরুন এবং পত্রিকা চরিত্র গড়ে ওঠার কাহিনি অজানা থাকার কারণে পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে একটা বিপজ্জনক ধারণা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে- অমুক পত্রিকা প্রতিক্রিয়াশীল, তমুক পত্রিকা প্রগতিবাদী। ধারণাটা আগাপাশতলা ভুল।


       সমস্ত বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর ও নিউজ চ্যানেলের মালিকরাই এক একটি ধনকুবের, এবং সবারই মূল চরিত্র একই। সমাজ কাঠামোকে আঘাত না দিয়ে আমি আপনি যত খুশি লম্ফ-ঝম্ফ দিতে পারি। চাই কি, তার জন্য প্রচারও পেতে পারি। কিন্তু ‘সিস্টেম’কে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করলে ওরা প্রত্যাঘাত হানবে সর্বশক্তি দিয়ে।


       আর প্রচার মাধ্যমের সে শক্তি এতই বিশাল যে সাধারণের কল্পনাতীত। জনগণকে প্রভাবিত করার এই বিশাল শক্তিই তাকে দিয়েছে ‘সিস্টেম’-এর বনিয়াদের এক গুরুত্বপূর্ণ পিলারের ভূমিকা। কয়েক বছর হল সংবাদপত্রের পাশাপাশি নিউজ চ্যানেল নিয়েও এই ধরনের ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। প্রচার মাধ্যমের অকল্পনীয় শক্তির প্রসঙ্গে পরে আসব, আপাতত প্রসঙ্গে ফিরি।


       বৃহৎ নিউজ মিডিয়াগুলো তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের খদ্দের ধরতে বহিরঙ্গকে সাজায় নানাভাবে। জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে তারই রাজনীতির ইমেজ বা সরকার বিরোধী ইমেজ তৈরি করে বিক্রি বাড়িয়ে চলে। এইসব মিডিয়ার সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের অবস্থান মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের ফুটবল টিমের কোচ ও খেলোয়াড়দের মতোই- যখন যে দলে খেলবেন, সেই দলকে জয়ী করতেই সচেষ্ট থাকেন। প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা বলে যাকে আপনি গাল পাড়েন, তারই অতিক্ষমতা সম্পন্ন দুঁদে বার্তাসম্পাদক কিংবা ঝাণ্টু সাংবাদিক আপনার মনে হওয়া প্রগতিবাদী পত্রিকায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার স্বার্থে কলম থেকে ঝরাতে থাকেন বিপ্লবী আগুন। একই ভাবে বিপরীত ঘটনাও ক্রিয়াশীল। প্রগতিশীল পত্রিকার বিপ্লবী কলমও টিম পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবিপ্লবী কলম হয়ে ওঠে। এই জাতীয় উদাহরণ কিন্তু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত নয়, বরং সাবলীল গতিশীল। এইসব বিপ্লবী, প্রতিবাদী, প্রতিবিপ্লবী, বুর্জোয়া প্রভৃতি প্রতিটি বাণিজ্যিক মিডিয়ার মালিকদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। একজনকে ধন-সম্পদে আর একজনের টপ্‌কে যাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক কোনও শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ওরা দারুণ রকম এককাট্টা।


       মিডিয়াগুলোর ভানের মুখোশটুকু সরালে দেখতে পাবেন, প্রতিটি মিডিয়াই বর্তমান সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে জনমতকে পরিচালিত করে এবং বহিরঙ্গে এরা সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের কিছু কিছু দুর্নীতির কথা ছেপে সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখার মূল ঝোঁককে আড়াল করে। এমন সব দুর্নীতির কথা ‘পাবলিক’ খায় বলেই মিডিয়াগুলো প্রচারে আনে। এই সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি যাদের হাতে, তারা জানে, এমন দু-চারটে দুর্নীতি ধরার লালিপপ্‌ হাতে ধরিয়ে দিয়ে কীভাবে অত্যাচারিতের ক্ষোভের আগুনে জল ঢালতে হয়। তারা জানে, সিস্টেমের প্রেসার কুকারে নিপীড়িতদের ফুটন্ত ক্ষোভকে বের করে দেওয়ার ‘সেফটি ভালভ’ হল মাঝে-মধ্যে দু-চারজনের দুর্নীতি ফাঁস। পরে অবশ্য দুর্নীতিগ্রস্তকে শাস্তি-টাস্তি না দিলে ক্ষতি নেই। জনগণের স্মৃতি খুবই দুর্বল। ভুলে যাবে প্রতিটি ঘটনা, যেভাবে ভুলেছে বর্ফস কেলেঙ্কারি, শেয়ার কেলেঙ্কারি। আর এর ফলে এক-আধটা রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ বা প্রশাসক যদি বধ হয়, তাতেও অবস্থা একটুও পাল্টাবে না। ফাঁকা জায়গা কোনও দিনই ফাঁকা থাকে না, থাকবে না। এক যায়, আর এক আসে।


       এইভাবে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দুর্নীতিগ্রস্তরা আসে এবং বিদায়ও নেয়, কিন্তু দুর্নীতি টিকেই থাকে। এই দুর্নীতির সূত্রেই বাঁধা পড়ে থাকে ‘সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তিগুলো।


       কখনও কখনও বাণিজ্য সাম্রাজ্যের অধিকারীরা রাজনীতিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিজের ক্ষমতা রক্ষা ও বর্ধিত করতে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল উদ্যোগী হয়। এখানেও কিন্তু বাণিজ্য-সম্রাটের পক্ষে মিডিয়ার বাণিজ্যিক সাফল্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। যে পত্রিকা বিক্রি হয় না, যে চ্যানেল লোকে দেখে না তাকে কেন রাজনীতিক দল পাত্তা দেবে?


       যে-সব সাংবাদিক বা মিডিয়াকর্মী সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন, দুর্নীতির শিকল ভেঙ্গে সুসংস্কৃতির সমাজ গড়তে চান, তাঁদের পক্ষেও কলমকে মগজকে হাতিয়ার করে মিডিয়াকে রণভূমি করা সম্ভব হয় না। কারণ পত্রিকায় ব্যক্তি ইচ্ছে বা ব্যক্তি আবেগের স্থান সীমাবদ্ধ। মিডিয়ার পলিসির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই একজন সাংবাদিককে চলতে হয়। কোনও সাংবাদিকের পক্ষে একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ততক্ষণই সহযোগিতা করা সম্ভব যতক্ষণ না পেপার পলিসি ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে যায়।


       মিডিয়া পলিসি কাউকে ব্ল্যাক-আউট করতে চাইলে বা কারও বিপক্ষে গেলে তাকে প্রচারে আনা কোনও সাংবাদিকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কিন্তু মিডিয়া মালিক যদি দেখেন কাউকে ব্ল্যাক-আউট করার ফলে অথবা কারও বিপক্ষে লেখার ফলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখে, তখন ব্যবসার স্বার্থেই তাঁরা পলিসি পালটে ফেলেন, ডিগবাজি খান। এই ডিগবাজি খাওয়াটাও ততক্ষণই সম্ভব, যতক্ষণ না ওই ব্যক্তি বা সংস্থা পত্রিকা মালিকের অস্তিত্বের পক্ষে চূড়ান্ত সংকট হিসেবে হাজির হচ্ছে।


       বাণিজ্যিক টিভি চ্যানেল পত্র-পত্রিকার বাস্তব কাঠামো বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, ভুল বোঝার অবকাশ বেশি থাকে। আর এই ভুলই বহু সৎ ও গতিশীল আন্দোলনে ধস্‌ নামাতে পারে। সত্যিকারের আন্দোলনের পাল থেকে জনসমর্থনের হাওয়া কেড়ে নিতে মেকি আন্দোলনকারী খাড়া করে তথাকথিত প্রগতিশীল নিরপেক্ষ মিডিয়া যখন ময়দানে নামে, তখন ভ্রান্ত ধারণা বহু সমর্থককে, বহু আন্দোলন-কর্মীকে দূরে সরিয়ে দেয়।


       বিভিন্ন প্রচার-মাধ্যম বা পত্র-পত্রিকা যেমন বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনের নেতৃত্বকে ‘মিডিয়া পলিসি’র পক্ষে কাজে লাগায়। নিজস্ব ছাঁচের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ার পক্ষে কাজে লাগায়, তেমনই শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কেন পারবে না প্রচার-মাধ্যমগুলোকে যতদূর সম্ভব কাজে লাগাতে? কাজে লাগানো সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্লোভ ও সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব চেষ্টা করলে দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করে, প্রচার-মাধ্যম দ্বারা ব্যবহৃত না হয়ে প্রচার-মাধ্যমকেই ব্যবহার করতে পারেন।


       যে মিডিয়ার পাঠক ও দর্শক সংখ্যা যত বেশি, জনগণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও তার তত বেশি।


       পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কি তবে কোনও স্বাধীনতা নেই? ক্ষমতা নেই? নিশ্চয়ই আছে। ওদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা আছে, পেপার পলিসির সঙ্গে সংঘর্ষে না নামা কাউকে প্রচার দেওয়া, বা বিশেষ কোনও সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, আইনি অধিকার বা বে-আইনি সুবিধে আদায়ে সহযোগিতা করা, অপছন্দের মানুষ বা সংস্থাকে কিঞ্চিৎ টাইট দেওয়া। এবং স্বভাবতই এই ক্ষমতা একটু বেশি পরিমাণে থাকে সম্পাদকের ও তাঁর প্রিয় সাংবাদিকদের। অনেক সময় ওদের কৃপায় অনেক ‘না’ ‘হ্যাঁ’ হয়ে যায়, অনেক ‘মিথ্যে’ হয়ে ওঠে ‘সত্যি’, অনেক জোনাকি মিথ্যে প্রচারের আলোতে নক্ষত্র হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে কিংবদন্তি।


আরও একটি প্রবল ক্ষমতা সংবাদ মাধ্যমগুলোর কর্তাব্যক্তিদের আছে। আর তা হল, কাউকে ‘ব্ল্যাক আউট’ করার ক্ষমতা।


       সংবাদ মাধ্যমগুলো বাস্তবিকই পারে ‘জোনাকি’কে ‘নক্ষত্র’ বানাতে, সত্যের সূর্য ঢাকতে পারে ‘ব্ল্যাক-আউট’-এর মেঘে।


       এই দুই ক্ষমতাই ‘নামী’ হতে চাওয়া, ‘জনপ্রিয়’ হতে চাওয়া, ‘দামি’ হতে চাওয়া, ‘পুরস্কৃত’ হতে চাওয়া, ‘সম্মানিত’ হতে চাওয়া বুদ্ধিজীবীদের (যাদের মধ্যে সাধারণভাবে ফেলা হয় সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী, চিত্রকর, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী, শিক্ষাবিদ, চলচ্চিত্র পরিচালক-সহ অধুনা ক্রীড়াবিদ্‌দের পর্যন্ত) সংবাদ মাধ্যমগুলো কাছাকাছি নিয়ে আসে। ‘নামী’ ‘দামি’ হওয়ার একটা পর্যায় অতিক্রম করে আরও ‘নামী’ ‘দামি’ হতে গেলে সাধারণভাবে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে আপস করা প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বুদ্ধিজীবীদের এই আপসকামিতাকে, কৃপাপ্রার্থী মানসিকতাকে শেষ পর্যন্ত কাজে লাগায় প্রচার মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রক শক্তি ধনকুবের পুঁজিপতিরাই।


*এই লেখাটি হিন্দি পত্রিকা " দৈনিক ভারতমিত্র " তে প্রকাশিত হয়েছে ১২ জুলাই ২০১৫ তে। সাংবাদিক সন্তোষ শর্মা, প্রবীর ঘোষের উক্ত লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। 

শ্রাদ্ধকর্ম হল ব্রাহ্মণ্য ধান্দাবাজি

-প্রশান্তকুমার মন্ডল।


মৃত পিতামাতার শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ পুরোহিত আপনাকে দিয়ে যে মন্ত্রপাঠ  করায়  সে মন্ত্রের অর্থ জানেন কী ?

সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থে এরা মানুষকে জাতের নামে হীন, নীচ প্রতিপন্ন করেছে, শ্রাদ্ধকর্মে ও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। শ্রাদ্ধের মন্ত্রের অর্থ না জেনে ব্রাহ্মণের কথায় বোকা যজমান কেমন নিজেকে এবং নিজের জন্মদাতা মৃত পিতা-মাতাকে গালাগালি করে দেখুন।


  “ পাপহম " পাপকর্মাহম পাপাত্মা পাপসম্ভবা

  " ত্রাহিমাম " কৃপাদেবা স্মরণাগতা বাৎসল্য

অর্থ হল..

পাপহম = আমি পাপী।

পাপকর্মাহম = আমি পাপ কর্মের ফল।

পাপাত্মা = আমার আত্মা পাপী।

পাপসম্ভবা = আমার দ্বারা পাপই সম্ভব। ত্রাহিমাম কৃপাদেবা স্মরণাগতা

বাৎসল্য = হে দেব কৃপা করে সন্তানসম স্মরণাগতকে  আশ্রয় দিন।


আপনি কেন পাপী ?

কোনো পাপ কাজ আপনি করেছেন কী ?

আপনার পিতা-মাতার পাপকর্মের ফলে আপনার জন্ম হয়েছে কী ?

সত্যি তাই কী ?

আপনি যদি কাল্পনিক আত্মায় বিশ্বাস করেন তাহলে সে আত্মা পাপী হল কিভাবে ? আপনার থেকে কী সব পাপই উৎপন্ন হবে ? 

শাস্ত্র অনুযায়ী দেবদেবী ব্রাহ্মণের মুখ দিয়ে খায়,ব্রাহ্মণের মুখ দিয়ে কথা বলে। সাধারন মানুষ ডাকলেও আসবে না, খাবেও না্,কথাও বলবে না। আবার শ্রাদ্ধ করলে মৃত পিতৃ পুরুষগন ব্রাহ্মণের কথায় ওঠাবসা করে। ব্রাহ্মণের কথায় তারা আসবে এবং ব্রাহ্মণের কথায় তারা উত্তর পুরষদের প্রচুর দান করবে। মানুষের এমন অন্ধবিশ্বাস এবং এমন " নির্লজ্জ পুরোহিত তন্ত্র " পৃথিবীর কোনো ধর্মে নেই।

ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট দেবদেবীরা ব্রাহ্মণের কথায় সাড়া দেয়, কেবল ব্রাহ্মণের সাথে কথা বলে, ব্রাহ্মণ খাদ্য চিবিয়ে দিলে তবে খায় এবং ব্রাহ্মণের কথায় যজমানকে সবকিছু দান করে। বিনিময়ে ব্রাহ্মণ যজমানের দেত্তয়া সামান্য কিছু নিয়ে সন্তুষ্ঠ হয়। এমন মহান হৃদয় ভারতীয় ব্রাহ্মন পুরোহিতদের। নিজের জন্য তবু দেবতাদের কাছে এরা কিছুই চায় না। বোকা যজমানদের এমন মিথ্যাবুলি শিখিয়েছে ব্রাহ্মন পুরোহিত। বোকা যজমানরা জানে না যে, ব্রাহ্মণের তৈরী জড় পদার্থের " পুতুল দেবদেবী " শুধুই তাদেরকে ঠকানোর জন্য। যজমানরা কি কোনো দিন ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করেছেন ? যে আপনারা শুধু আমাদের জন্য দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করেন কেন? আর আমাদের দেওয়া অল্প সম্পদে সন্তুষ্ট হন কেন ? আপনারা দেবদেবীর কাছে নিজেরা ইচ্ছামত চেয়ে নেন না কেন? দেবদেবীর কাছে চাইলে যদি সব পাওয়া যেত তাহলে তো আর আপনাদের অভাব থাকতো না। এমন সরল প্রশ্নটি যজমানরা কেন করেন না? বাবা, মায়ের মৃত্যূর পর তাঁদের আত্মা-প্রেতাত্মা ও ব্রাহ্মনের কথায় নাকি উঠবোস করেন, এমন দাবি ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের।দেবদেবীরা যেমন ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট খায় আত্মা-প্রেতাত্মারা ও নাকি ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট খেয়ে ধন্য হয়।

ভূ-দেবতা সেজে এরা জীবিত মানুষকে উচ্ছিষ্ট খাইয়েছে আর মৃত্যূর পর তার প্রেতাত্মাকেও উচ্ছিষ্ট খাওয়ায়।

কেন খাবে না ? সমস্ত দেবদেবী যদি ব্রাহ্মণ পুরোহিতের চিবিয়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে ধন্য হয়, মানুষ খাবে না কেন ?

এমন জঘণ্য বিশ্বাস হিন্দুদের।


সারা জীবন বাড়ীতে এসে হাজর বাজর মন্ত্র আউড়ে যে ব্রাহ্মণ দেবদেবীর কাছ থেকে একটা পয়সা আদায় করে দিতে পারেনি, সেই বাড়ীর ছেলে আবার ঐ ব্রাহ্মন পুরোহিতের কাছে ছুটছে মৃত বাবা/মাকে স্বর্গে পাঠানোর জন্য। এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে।

বোকা যজমানারা আর কবে বুঝবে এসব দেবদেবী কাল্পনিক আর কর্মফল, আত্মা, প্রেতাত্মা, জন্মান্তরবাদ, স্বর্গ, নরক সব ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ধানদাবাজি।

শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মন্ত্রবলে মৃতের পূর্বপুরষরা দলে দলে আসবে আর প্রচুর ধনসম্পদ দান করবে মৃতের সন্তানদের।

এমন বিশ্বাস কী পৃথিবীর কোন ও সভ্য মানুষ করে?

চার্বাক পন্ডিত মাধবাচার্য বলেছেন-“ স্বর্গ-নরক " নেই,পারলৌকিক আত্মা নেই, বর্নাশ্রমাদির ক্রিয়া নিষ্ফল।

অগ্নিহোত্র তিনবেদ ( ঋক, সাম ও যজু ) ত্রিদন্ড, ছাইভস্ম লেপন, বুদ্ধিহীন ও পৌরুষহীন, নিষ্কর্মা মানুষের জীবিকার উপায় মাত্র।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন - “ মৃত্যূর পর মানুষ স্বর্গে যায় এটা কল্পনা মাত্র। সজ্জন ব্যক্তি মৃত্যূর পর স্বর্গে গিয়ে অনন্ত সুখময় জীবন যাপন করে - এ ধারনা স্বপ্ন মাত্র। স্বর্গ ও নরক এসব আদিম ধারনা। ( বানী ও রচনা -দশম খন্ড -পৃষ্ঠা ১৫৯ )

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন.. পৌরোহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। যেখানে পুরোহিত তন্ত্রের আবির্ভাব সেখানেই ধর্মের গ্লানি।( জাতি, সংস্কৃতি ও সমাজ, স্বামী বিবেকানন্দ )

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন.. প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কবিহীন লোকগুলো কখনও শুধরোবে না। আগে তাদের নির্মূল করো। এস মানুষ হও। ( জাতি,সংস্কৃতি ও সমাজ, স্বাঃবি. পৃষ্ঠা - ২৮ )

স্বামী বিবেকানন্দ  “ আত্মা তো নিত্য মুক্ত।তার আবার মুক্তির চেষ্টা কি? (স্বাঃ বি. বানী ওরচনা - ৯ম/২১৬ পৃঃ )

শ্রীচৈতন্যদেব - পুরোহিতগনকে রাক্ষসদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ( চৈতন্য চরিতামৃতে )

ডঃআম্বেদকর -“ ধূর্ত ব্রাহ্মণ'রা " শাস্ত্র রচনা করে হিন্দুদেরকে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে ( আঃ রঃ বঃ ১ম/২৫৬ পৃঃ )

স্বামী বিবেকানন্দ - “ যে শাস্ত্র বলছে.. তথাপি লোকাচার। অর্থাৎ তবুও মানুষ লোকাচারই অনুসরন করিবে্‌, সে সব শাস্ত্র-দূরে নিক্ষেপ করুন্‌, সেগুলি অর্থহীন ”। ( স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র. ৩/৩০০ পৃঃ )

 বাবাসাহেব ড.বি.আর. আম্বেদকর ..

মৃত্যূ উপলক্ষে অশৌচ পালন অপেক্ষা শোকদিবস পালন করাই যুক্তিযুক্ত। শ্রাদ্ধ নয়, শ্রদ্ধা প্রদর্শনই মৃতের  প্রতি যথার্থ  সম্মান জানানো।                   

পাগলচাঁদ.. 

“ শ্রাদ্ধ " হলো ব্রাহ্মণদের শোষনের কৌশল।মৃত ব্যক্তির জন্য শ্রাদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই। জীবিত অবস্হায় পিতামাতার আশীর্বাদই সন্তানের সবচেয়ে বেশী কল্যান”।    


পন্ডিত দিগিন্দ্র নারায়ন ভট্টাচার্য..

তাঁর বই “ হিন্দুধর্মের ব্যাধি ও চিকিৎসা ” গ্রন্থের বঙ্গ বৈশ্য ক্ষত্রিয় নামক অধ্যায়ে  বলেছেন - হৃদয়হীন ব্রাহ্মণ পন্ডিতগনের আশা ত্যাগ করো। পাষানে নাস্তি কর্দম।শকুনের দৃষ্টি যেমন মরা গরুর মাংসের দিকে ইহাদের দৃষ্টি ও লক্ষ্যও তেমনি ভারতের মুমুর্ষু হিন্দু নর-নারীর দিকে।


 ব্রাহ্মণের ফাঁদে পা দিয়ে মৃত পিতা-মাতার জন্য শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা মানে বাড়িতে ব্রাহ্মণ ডেকে মৃত পিতা-মাতাকে গালাগালি করা, অসম্মান করা। তাই ব্রাহ্মণের কথায় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নয়, " শ্রদ্ধা " অনুষ্ঠান করুন।অনাত্মীয় নাপিত, ব্রাহ্মণ নয়, নিজের আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930